প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী, (১৮২৫ — ১৮৮৬) ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি অধ্যাপক এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও বাল্যবন্ধু ছিলেন তিনি।
জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন
প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারীর জন্ম ১২৩২ বঙ্গাব্দের (১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের) অগ্রহায়ণী পূর্ণিমার প্রথম রাসের দিন ব্রিটিশ ভারতের অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার খানাকুল উন্নয়ন ব্লকের রাধানগর গ্রামের এক কায়স্থ পরিবারে। "সঙ্গীত লহরী" ও "তীর্থভ্রমণ" গ্রন্থের রচয়িতা যদুনাথ সর্বাধিকারী (১৮০৫ - ১৮৭০) ছিলেন তার পিতা। যদুনাথ দু'বার বিবাহ করেন। প্রথম পক্ষের ছয় সন্তানদের (চার পুত্র ও দুই কন্যা) মধ্যে প্রসন্নকুমারই ছিলেন জ্যেষ্ঠ। অন্য পুত্রেরা হলেন- প্রখ্যাত চিকিৎসক সূর্যকুমার, আনন্দকুমার ও রাজকুমার। প্রসন্নকুমার গ্রামে পিতার প্রতিষ্ঠিত পাঠশালায় সংস্কৃত, ইংরাজী ও ফরাসি শেখেন। এরপর কলকাতার হিন্দু কলেজে ভরতি হন। প্রসন্নকুমার ও বিদ্যাসাগর সহপাঠী ছিলেন। বিদ্যাসাগর প্রসন্নকুমারের নিকট ইংরাজী পড়তেন এবং প্রসন্নকুমার বিদ্যাসাগরের কাছে সংস্কৃত পড়তেন। তাদের পরস্পরের বিদ্যা-সাহচর্য্যকে উপলক্ষ করে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপকগণ বলতেন - "সম্পৎ বিনিময়ে নোভৌ দধতুভূবনদ্বয়ম্" । প্রসন্নকুমার কৃতিত্বের সঙ্গে জুনিয়র ও সিনিয়র বৃত্তি পাশ করে স্বর্ণপদক লাভ করেন।
কর্মজীবন
শিক্ষা সমাপনান্তে প্রসন্নকুমার কিছুদিন ঢাকা কলেজে অধ্যাপনা করেন। এরপর মুর্শিদাবাদ রাজসরকারের উচ্চপদ লাভ করেন। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও সংস্কৃত স্কুল ও কলেজ আলাদা আলাদা পরিচয়ে চলতে থাকে এবং সেসময় প্রসন্নকুমার সংস্কৃত স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক হন। তারপরে তিনি আবাল্য বন্ধু বিদ্যাসাগরের চেষ্টাতেই প্রথমে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক ও পরে অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন। প্রসন্নকুমারের আগে অবশ্য কোন কায়স্থ এইপদে আসীন হন নি। কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিরোধের কারণে তাকে অধ্যক্ষের পদ ছাড়তে হয়। কিন্তু কলেজের সকল ছাত্র, অধ্যাপক ও কর্মচারীরা সকলেই কলেজ ত্যাগ করলে তিনি অধ্যক্ষ পদে পুনর্নিযুক্ত হন। তবে কিছুদিন পর তাকে প্রেসিডেন্সি বিভাগের স্কুল ইন্সপেক্টর পদে নিযুক্ত করে সরিয়ে দেওয়া হয়। পরে অবশ্য প্রসন্নকুমার বহরমপুর কলেজের অধ্যক্ষ ও প্রেসিডেন্সি কলেজে ইতিহাস ও ইংরাজীর অধ্যাপক হয়েছিলেন।
গণিত ও জ্যোতিষেও তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। সূর্যগ্রহণ নিয়ে সেসময়ে প্রচলিত দেশি ও বিদেশি ভ্রান্ত ধারণা প্রমাণ করেন এবং এর ফলে তিনি পণ্ডিত সমাজের বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র হন। বিদ্যাসাগরের সহায়তায় বাংলা ভাষায় বীজগণিত ও পাটিগণিতের পরিভাষা সৃষ্টি করে গণিতের বই রচনা ছিল তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি। প্রসন্নকুমার মহাভারত অনুবাদে কালীপ্রসন্ন সিংহকে (১৮৪১- ১৮৭০), অভিধান প্রণয়নে তারানাথ তর্কবাচস্পতিকে (১৮১২ - ১৮৮৫) ও শাস্ত্রগ্রন্থ রচনায় সত্যব্রত সমাধ্যায়ীকে(১৮৪৬-১৯১১) সহায়তা করেন। প্রসন্নকুমার তৎকালীন বঙ্গীয় আইন সভার এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সদস্য ছিলেন। প্রসন্নকুমার ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুন হিন্দু বিধবাদের সাহায্যার্থে বিদ্যাসাগর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত "হিন্দু ফ্যামিলী অ্যানুইটি ফান্ড"-এর বোর্ড অফ ডিরেক্টরের অন্যতম সদস্য ছিলেন। তিনি মধুসূদন ও বিদ্যাসাগরের বিপদের সময় সাহায্য করে মানবতার পরিচয় দেন। প্রসন্নকুমার কর্মজীবনের নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠা, গরিবের অন্নের ব্যবস্থা, অভাবী মানুষের সাহায্যে প্রায় অর্থশতাব্দী ধরে নানা কল্যাণমূলক কাজ করে গেছেন। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর পর তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের মুখ্যসচিব চার্লস ওয়াল্টার বোল্টন এক জনসভায় প্রসন্নকুমারের স্মৃতিতে এক প্রতিকৃতির ও আবক্ষ মূর্তি উন্মোচন করে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।
তথ্যসূত্র